রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০২ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
প্রত্যেক মানুষের ব্যবহারিক জীবন আলাদা হলেও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে তাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও আচার-আচরণ মানতে হয়ে। এ প্রেক্ষাপটে কোরআন-হাদিসের আলোকে আমরা যে ইসলাম পাই, সেটা এক ইসলাম। ওই ইসলামের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। কিন্তু অনেকের ব্যবহারিক জীবন লক্ষ করলে দেখা যায়, এই এক ইসলামকে একেকজন একেকভাবে গ্রহণ করেছে, ভিন্নভাবে ধারণ করছে ইসলামের মূল্যবোধ। ফলে নানা ধরনের ভিন্নতা, মতপার্থক্য, তর্কবিতর্ক ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। যদিও ইসলাম এ অবস্থা নিরসনে নানাবিধ বিধান দিয়েছে, যা সামাজিকভাবে সাম্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একতাবদ্ধ জীবনের শিক্ষা দেয়।
বলা হয়, মানুষ যখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছে কাঁধে কাঁধে লাগিয়ে; পায়ের গোড়ালির সঙ্গে গোড়ালি মিলিয়ে- এ ব্যবস্থা থেকেও তো উপলব্ধি করা যায়, ধনগত বৈষম্য, গায়ের রংগত বৈষম্য, ভাষাগত বৈষম্য, অঞ্চলগত বৈষম্য কিংবা এরকম কোনো বৈষম্য ইসলামে কাম্য নয়। তাহলে মানুষ বৈষম্য সৃষ্টি করছে কীভাবে? স্পষ্ট উত্তর, নিজেদের অজ্ঞতা থেকে, ইসলামের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে; নিজেদের ভেতরকার চৈতন্যবোধ হারিয়ে। অথচ জীবন গড়ার জন্য চেতনা, জ্ঞান-সাধনা, শিক্ষা-গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিকল্প নেই। এসবের জন্য দরকার জাগরণ সৃষ্টি, আর যেকোনো জাতির মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির জন্য ইতিহাসচর্চা অপরিহার্য বিষয়।
এটা কোনো নতুন দাবি নয়, বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে- মুসলিম সভ্যতা। ইসলামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে এ সভ্যতা। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটা গড়ে উঠেছে যুক্তির ওপর ভিত্তি করে। ইসলাম বিশ্বকে এমন এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে, যা গোটা মানবজাতি বিশেষ করে মুসলমানদের চিরঋণী করে রেখেছে। যদিও মুসলিম সভ্যতার অবদান সম্পর্কে বর্তমান সময়ের মানুষ খুব একটা অবহিত নয়। অথচ নিজের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। নিজের পূর্বসূরিরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে কোন পর্যায়ে এবং কোন অবস্থানে ছিলেন, সে সম্পর্কে জানলে সামনে পথচলা সহজতর হয়। আত্মপরিচয় দৃঢ় হয়, এছাড়া নিজের অতীত সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান নয়া প্রজন্মের মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইতিহাসের নানা পর্যায়ে ও বাঁকে মুসলিম সভ্যতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে উপনিবেশবাদীরা গত দুই শতাব্দী ধরে মুসলমানদের মৌলিকত্ব, মর্যাদা ও কর্মক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রাচ্যের দেশগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতা প্রত্যাখ্যানের পেছনে পাশ্চাত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, প্রাচ্যের দেশ ও জাতিগুলোর নানা অর্জনকে অস্বীকার করে তাদের সব উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনকে নিজেদের অর্জন হিসেবে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঠেকানো।
পশ্চিমারা মুসলিম সভ্যতার উন্নতি ও উৎকর্ষ বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো দেশ ও জাতি এমন আধিপত্য মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার কৌশল বেছে নেয়। বিশেষ করে তারা মুসলিম দেশগুলোতে সুকৌশলে ও ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। এমতাবস্থায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে বড় করে দেখা দিয়েছে, মুসলিম সভ্যতার উৎস, সামাজিক প্রভাব এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা। কারণ, মানুষ ভুলে যাচ্ছে, মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে, ফলে মুসলিম সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম সভ্যতা হচ্ছে- জীবন্ত ও গতিময়, এই সভ্যতা সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর এ ধরনের গতিময় সভ্যতা যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। মুসলিম সভ্যতা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বারবার বিজাতীয় আগ্রাসনের শিকার হওয়ার পরও পাশ্চাত্যের কাছে নতিস্বীকার করেনি। ইরানি, মিসরীয়, ভারতীয়, আফ্রিকান ও আরব সংস্কৃতির মতো বিভিন্ন স্থানীয় সংস্কৃতিকে টিকে থাকার সুযোগ দেওয়ার কারণে মুসলিম সভ্যতা ক্রমেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে সব সংস্কৃতিকে একীভূত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে এটা স্পষ্ট যে, এখানে সব সংস্কৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। মুসলিম সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মুসলিম সভ্যতার গতিময়তার কারণ হলো, বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া ও স্বীকৃতি দেওয়া। মুসলিম সভ্যতায় জাতিগত বৈষম্যের কোনো স্থান নেই এবং এটি কোনো বিশেষ জাতি-শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ইসলাম হচ্ছে, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধর্ম এবং ইসলাম এটা প্রমাণ করেছে যে, এই ধর্ম মানুষকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে পারে। মানুষের ভেতরে উন্নত মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। যে মূল্যবোধের আলোয় সমাজ হয়, আলোকিত ও শান্তিময়।
মুসলিম সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যাবতীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকা। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতি কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইসলাম ধর্ম, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাভিত্তিক যে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে, তা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শেকল ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেছে। ইসলামি শিক্ষা, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করার পাশাপাশি প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জ্বল মুসলিম সভ্যতা গড়ে ওঠার ও তা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।
ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও ধর্মের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক দিককে গুরুত্ব দেয়। ধর্ম হচ্ছে, মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতি সাধনের মাধ্যম এবং জ্ঞান ও বিবেকের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সঙ্গে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের মাধ্যমে সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে। এমন সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে, আত্মাসচেতনতা, সংগ্রাম ও সাধনা। সেই সভ্যতাকে অস্বীকার ইতিহাস বিকৃতি ও সত্য লুকানোর শামিল।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক